হৃদয়ের কালিতে লেখা ইতিহাস ২৬ সেপ্টেম্বর
উম্মে ফারিহা: ২৬ সেপ্টেম্বর। আজও ঈমানী চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। এই ২৬ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছি ইসলামী হুকুমত কায়েম হওয়ার তরে ত্যাগ ও কুরবানীর মধ্য দিয়ে দিনের রাহবারদের সহযোগী হওয়ার। সেদিন ক্ষুদ্র মনটাকে ভেঙে গড়ে ছিল শক্তিশালী ও জিহাদি চেতনার হৃদয়।
শৈশবের দিনগুলো মাদ্রাসার আঙ্গিনায় সাথীদের সাথে দুরন্তপনার মধ্য দিয়েই কাটাতে লাগলাম। ইচ্ছে ছিল এই ভালোলাগার সময়গুলো দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে উঠেনি। এর আগেই সাথীদের থেকে বিচ্ছেদ হতে হয়েছে। আব্বু-আম্মুর অসুস্থতার কারণে চলে আসতে হয়েছে আরো আগেই। মাদ্রাসা থেকে এসে সাথীদের বিরহ বেদনায় সময় কাটাতে লাগলাম।
এর মধ্যে ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। ছয় মাস পর দাম্পত্য জীবনের হাতছানি শুরু হলো। বিভিন্ন দিক থেকে বিয়ের আলোচনা হচ্ছিল। এরই মাঝে ফুফা মাওলানা মোস্তফা আল হোসাইনী রহ. একটা প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার হুকুমে পারিবারিকভাবে সেটাই চূড়ান্ত হলো।
শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। নতুন এক জীবনের পথচলা। সিদ্ধান্ত হলো, বিয়ের কয়েক মাস পরই আনুষ্ঠানিকতা হবে। সে হিসেবে বিয়ে পরবর্তী দিনগুলো মা-বাবার আদর সোহাগ ও তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় কাটাতে লাগলাম।
বিয়ের আগে এদেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব, পদ্ধতি, আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে তেমন একটা জানাশোনা ছিল না। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য কেউ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, মাঠে-ময়দানে চড়ে বেড়াচ্ছে- এসব কিছু জানতাম না। তবে আব্বু মাওলানা ইয়াকুব কাসেমী সাহেব মাঝে মাঝে পত্রিকা নিয়ে আসতেন। সেই পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন যুলুম-নির্যাতন, খুন ধর্ষণসহ এজাতীয় নিউজগুলো দেখে শুধু মনে মনে ভাবতাম- এদেশে যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা থাকতো তাহলে এই অন্যায়গুলো হতো না। এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হোক এটা প্রত্যাশা ছিলো হৃদয়ের গভীরে। বিয়ের পর তাঁর সংস্পর্শে এসেই জানতে পারি- আমার হৃদয়ের গভীরের সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়নের জন্য একদল মর্দেমুজাহিদ তরুণ-যুবক রাজপথে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। নিজেদের জীবন যৌবনকে বিলিয়ে দিচ্ছে সেই লক্ষ্য হাসিলের জন্য।
শুভ দিনের শুভ রাত্রি পার না হতেই কিশোরী নববধূকে ঘরে রেখেই ঢাকায় আন্দোলন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যখন অনুমতি চেয়ে বসে রইলেন, তখন অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। এখনই ঢাকা যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তখন খুব বেশি কিছু বলার সুযোগ ছিল না, তাই সামান্য কিছু কথা দ্বারা অনেক কিছু বুঝে নিয়েছিলাম। আর তখন থেকেই শুরু হলো ভালোবাসার পাশাপাশি ত্যাগ ও কুরবানীকে সঙ্গী করা। হৃদয়ের আবেগ অনুভূতি ও ভালো লাগা ভালোবাসা আদান প্রদানের পাশাপাশি সংগঠন সম্পর্কে একটু আধটু জানা হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। তখনো ভালোবাসার পূর্ণ স্রোত বয়ে যাওয়া হৃদয়কে যন্ত্রণার কষাঘাত সহ্য করার মত মজবুত করে গড়ে তুলতে পারিনি। তাইতো জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনকেও বিষাদের মতই লাগছিল।
দিন গড়িয়ে রাত পেরিয়ে আসলো ২৬ সেপ্টেম্বর। মুহূর্তের মধ্যেই যেন সব দুমড়ে মুচড়ে গেল। অক্সিজেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। প্রতিদিনের মতোই সেদিন দুপুরে খাওয়া শেষ করে মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিলাম। কল রিসিভ হয়নি। কেটেও দেইনি। অন্য সময়ে তিনি ব্যস্ত থাকলে কল কেটে দিতেন। পরে আবার ব্যাক করতেন। কিন্তু আজকে রিসিভ করেননি, কেটেও দেননি। কখনো বা ম্যাসেজে বলে দিতেন- ‘এখন ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো।’ কিন্তু আজকে এর কোনোটাই হচ্ছেনা। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে শুয়ে শুয়ে কল অথবা ম্যাসেজের অপেক্ষায় থাকলাম। কিছুক্ষণ পর একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ আসলো- “একটি জরুরী কাজে অফিস থেকে বের হয়েছি। সুযোগ হলে পরে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।”
বুঝলাম, অন্য কারো নাম্বার থেকে তিনি হয়তো ম্যাসেজ দিয়েছেন। এরপর ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেন জানি আজ ঘুম আসছে না। শুধু বিছানায় এদিক ওদিক ছটপট করছি। এরই মধ্যে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখনও কোনো কল আসেনি। কোন খোঁজখবর নেই। এই অবস্থার মাঝে আবার কল দিলাম। কিন্তু এখন আর কল যায় না। মোবাইল বন্ধ। কিছুক্ষণ পর পর কল দিয়ে দেখি মোবাইল চালু হচ্ছে কিনা। আমার অস্থিরতা ও পেরেশানি আরো বেড়ে গেল। কারণ, ওনার মোবাইল এত দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার কথা না। জরুরি অনেক কল সবসময় তাঁর মোবাইলে আসে।
এভাবে বিকাল গড়িয়ে গেল। রাত্রে আব্বু আসলেন বাড়িতে। আজকে আব্বুর চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ। কথাবার্তাও অস্বাভাবিক, অন্যরকম। ভাবলাম, মাদ্রাসায় হয়তো কিছু হয়েছে। কিছুক্ষণ পর দেখি আম্মুরও একই অবস্থা। ঘরের মধ্যে এক ধরনের নিরবতা কাজ করছে। কেন এই অবস্থা হলো কিছুই বুঝতেছিনা। এভাবে রাত দশটা বেজে গেল। কারো খাওয়া-দাওয়ার কোন খবর নেই। আমি যখন রাতের খাবার খাওয়ার জন্য আব্বু আম্মুকে ডাকতে যাই তখন আম্মু শুধু এতোটুকুই বলেছে– ‘তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও। আমরা পরে খাবো।’ তখন শুধুই পেরেশানি। কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না, সইতেও পারছি না। শুধু একটা ফোনের অপেক্ষায় আছি। এই বুঝি কল আসছে আর আমি রিসিভ করার জন্য দৌড়ে যাচ্ছি। এই অবস্থা নিয়ে খানা শেষ করলাম। আহ! সেই খানাটা ছিল দীর্ঘ দিনের জন্য শেষ খানা। খাওয়ার সময়ও সেটা ভাবিনি। খাবার শেষে শোবার জন্য প্রস্তুতি নিতে দেখি আম্মু আমার রুমের দিকে আসছে। চেহারাটা মলিন। চোখে অশ্রু টলমল।
কাছে এসে বললেন- “আন্দোলন অফিস থেকে ছয়জনকে র্যাব গ্রেফতার করেছে। সেখানে গিলমানও আছে…!” এতটুকু বলেই আম্মু থেমে গেলেন। হয়তো আমাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো কথা আম্মুর মুখ থেকে আর বের হলো না। আম্মু চলে গেলেন। কথাটি শুনে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ঘর ভেঙে ছাদের ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছি যেন। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিশ্চুপ নিশ্চল বিছানায় বসে রইলাম অনেক্ষণ। পরে উঠে দাঁড়ালাম। কম্পিত পায়ে অজু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। পুরো রাত জায়নামাজেই কেটেছে। পরের দিনগুলো আরো কঠিন থেকে কঠিন হতে লাগলো। প্রচণ্ড জ্বরের কারণে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছি। হৃদয়ের মানুষটির অনির্দিষ্টকালের বিয়োগ ব্যথায় হৃদয়টা যখন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল, অসুস্থতায় শরীরের শক্তি হারিয়ে যখন বিছানার নিত্যসঙ্গী হয়ে গেলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ ভাইয়ের স্ত্রী সান্তনা দেওয়ার জন্য আমার কাছে কল করলেন। সেই দিনের সেই সান্তনায় তার কাছে আমি চিরঋণী। এই অধম কখনো সেই ঋণ শোধ করতে পারব না।
শত দুঃখ কষ্ট আর বেদনার মাঝে চলে এলো ঈদুল আজহা। ঈদ মানেই তো উৎসব। ঘরে ঘরে আনন্দ। কিন্তু আমাদের কিসের উৎসব? কিসের আনন্দ?? কাকে নিয়ে আনন্দ??? যে মায়ের একমাত্র ছেলে জালিমের জুলুমে নির্যাতিত হয়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রয়েছে, সে মায়ের কিসের আনন্দ! সন্তানের জন্য কতটুকু পাগলপারা হলে বাড়িতে থাকা পাঞ্জাবি বুকে জড়িয়ে ঘরের প্রতিটি রুমে গিয়ে গিয়ে ছেলেকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। যে বোনদের একটিমাত্র ভাই; যার প্রতি ঈদে রুটিন ছিল সবার আগে বোনদেরকে দেখে আসা – সে ভাইয়ের বিয়োগে বোনদের কিসের উৎসব!! যে নব দম্পতি তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনাতেই দুটি দেহ একটি প্রাণ হয়ে ভালোবাসার প্রতিটা ঢালে ঢালে ঘুরে বেড়াতে লাগল, সেই প্রেমাষ্পদের বিরহবিচ্ছেদে কিসের ঈদ আহ্লাদ!!! জালিমের জুলুম সয়ে আবার জীবিত ফিরে আসবে তো– সেই উৎকণ্ঠা সবার মাঝে বিরাজ করছিল। এভাবেই ঈদ বিহীন একটি ঈদ অতিবাহিত হল আমাদের থেকে। ছোট্ট হৃদয়ের সব আশা আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রইল।
স্বল্প সময়ে অল্প বয়সে যখন অনেক ঝড়-তুফান যেতে লাগল তখন মাথাটাও কাজ করছে না ঠিক মতো। আর সেই কারণেই হয়তো ভুলে গেলাম সাহাবীয়াদের জীবনী। ভুলে গিয়েছিলাম সোনালী ইতিহাস সৃষ্টির পেছনে থাকা মহিয়সি নারীদের সব ত্যাগ ও কুরবানীর কথা। আস্তে আস্তে পিঠটা একটু করে বিছানা থেকে আলাদা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আর চিন্তা করতে লাগলাম সে সব সাহাবীয়াদের জীবনী, যারা তাদের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিলেন দিনের জন্য। যারা তাদের স্বামীকে ফুলশয্যার রাতেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জিহাদের ময়দানে। আর সেখানেই সেই স্বামী শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছিলেন। স্মৃতির মিনারায় ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টাতেই সেসব কাহিনীগুলো একে একে মনে আসতে লাগলো। তখন মনে হলো- আমাদের ঈমান এত দুর্বল কেন! কেন আমরা এই ত্যাগ ও কোরবানি মেনে নিতে পারছি না!! আর তখন থেকেই শুরু হলো অন্তরের সাথে জিহাদ। ঈমানের বলে বলিয়ান হওয়ার চেষ্টা। দ্বীন কায়েম করতে হলে এর চেয়েও কঠিন ঝড় উপেক্ষা করতে হবে। তাই কোনোভাবেই ভেঙ্গে পড়া যাবে না। নিজেই নিজেকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করি।
আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানীতে এর কয়েক দিন পরই আকাশে উদিত হলো পূর্ণিমার চাঁদ। দীর্ঘ ২৭ দিনের বন্দি জীবনের অবসান ঘটল। এর জন্য আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবেনা। প্রথম যেদিন এই সংবাদ শোনামাত্রই শরীরের জ্বর এসেছিল দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত তা থেকে পরিত্রাণ পাইনি। কারাগার থেকে আসার পর কয়েকটি দিন কেটে গেল। কিন্তু সেখানকার অবস্থা, ২৬ দিন কিভাবে কাটল তা জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। এর অনেকদিন পর (তখনো শরীরের দাগ শুকায় নি) এক রাত্রে জেলখানার দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতে লাগলেন। একটু বলে চুপ হয়ে গেলেন। মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছিল না। কিন্তু অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। অতঃপর শরীরের দাগগুলো দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাকি অংশ। সেগুলো দেখে সহজেই অনুমেয় কতটুকু ভয়াবহ ছিল পাষণ্ডদের সেই নির্যাতন। এরপর কোন একদিন কাঁপাকাঁপা হাতে এগিয়ে দিলেন জেলখানার দিনগুলি বইটি। বইটি হাতে পেয়েও পড়তে সাহস হয়নি অনেকদিন। এভাবে পার হলো দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিকের দিনগুলি। যেগুলো স্মৃতির ডায়েরিতে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মাওলায়ে কারীমের কাছেও আমাদের এই প্রত্যাশা, তিনি যেন এই ত্যাগ ও কুরবানী আমাদের নাজাতের উসিলা বানিয়ে দিন।
পরিশেষে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত মুজাহিদদের মা-বোনদেরকে বলতে চাই- আপনারাই পারবেন ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সহযোগী হতে। ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করতে। আপনারা তাদেরকে জাগিয়ে তোলে সাজিয়ে পাঠিয়ে দিন ময়দানে। নির্যাতিত-নিপীড়িত নিরাপরাধ মানুষকে জালিমের বন্দিশালা থেকে বের করতে তাদেরকে উৎসাহ দিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। মায়েরা যদি তাদের ছেলেকে, স্ত্রীরা তাদের স্বামীকে বোনেরা ভাইকে উদ্বুদ্ধ করে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পাঠাতে পারে, তাহলে বিশ্বব্যাপী ইসলামের উত্থান ও বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।