গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করছি
মানসুর আহমদ সাকী:: আজ মহান বিজয় দিবস। ৪৮ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। তার আগে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণ ঝরেছে। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সেই মহান শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করছি।
পৃথিবীর বহু দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভ করেছে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে, বিনা রক্তপাতে। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে লাখো প্রাণের বিনিময়ে। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল এক অভিন্ন লক্ষ্যে। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গভীর জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্মৃতি। আমাদের ঐক্য ও সংহতির পেছনে ছিল ইসলাম ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন। আমরা এমন এক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম, যে রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি, লিঙ্গনির্বিশেষে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত হবে; অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বৈষম্যের অবসান ঘটবে। আমরা এমন এক ন্যায়পর সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেখানে সবার অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে, অশিক্ষা দূর হবে। আমরা এক সুখী, সৌহার্দ্যময়, সমৃদ্ধ ও কল্যানকর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম।
প্রতিবছর আমরা স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস উদ্যাপন করি। দুটি দিবসেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করি। একই সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও সংকল্পের কথা। আমরা আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই: আমরা কি আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পেরেছি? সামাজিক ন্যয় বিচার? সাম্য মানবিক মূল্যবোধ? ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি?
এ কথা সত্য যে গত ৪৭ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অগ্রগতি ঘটেছে। শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে; কৃষি খাতের অগ্রগতি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক, শিল্প খাতের প্রসার ঘটেছে এবং সাম্প্রতিক কালে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশও উল্লেখযোগ্য। অর্থনীতির সামগ্রিক অগ্রগতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূর হয়েছে, অপুষ্টি, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু ইত্যাদির হার কমেছে। তবে এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্য দূর হয়নি, এখনো বিপুল মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে ভুগছে। সামাজিক অন্যায়-অবিচার, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌতুক, ইত্যাদি অনেক সমস্যা আজও গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে বলেই আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে আজও ওঠেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মর্মকথা হলো গণতন্ত্র, যে গণতন্ত্রে আছে ন্যায়পরতা, নাগরিকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অধিকারের সমতা, পরমতসহিষ্ণুতা। আজ আমাদের রাজনীতি এসব নীতি থেকে অনেক দূরে। আমাদের গণতন্ত্র অনিশ্চিত ও ভঙ্গুর। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। এমনকি, একটি সরকারের মেয়াদ শেষে জনগণের মুক্ত-স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে সৎ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও এখনো গড়ে তোলা যায়নি।
আজকের এই মহান দিবসে আমরা সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নের কথা স্মরণ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক: সম্পাদক,
টাইমস-বিডি টুয়েন্টিফোর ডট কম