ধর্ষণ যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে একের পর এক
মুহা. তসলিম উদ্দিন রুবেল
কি হল আমাদের? ধর্ষণ যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, একের পর এক। একটা ধর্ষণের ঘটনা লেখা এবং প্রতিবাদ করার সাথে সাথে আরেক জায়গায় ঘটে যাচ্ছে। আবার এমন এমন ঘটনা, যেটা লেখা আর বলার কোন ভাষা নেই।
দেশ জুড়ে ধর্ষণ যেন মহামারি আকারে ধারণ করেছে। দেশের এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে এসব ঘটনা হচ্ছে না। পুরো দেশটা এখন ধর্ষণের মত সংস্কৃতিতে আক্রান্ত।
নারীদের সামাজিকভাবে সুরক্ষা দেয়ার রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্র তা কতটুকু পালন করছে? যখন নারীদের সুরক্ষা বিষয়টি আসে তখনই প্রশ্ন তোলা হয় নারীদের বাইরে বের হওয়া কিংবা কাজে যাওয়া অথবা তাদের পোশাকের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা হয় এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয় যে সকল কিছুর জন্য শুধু নারীরাই দায়ী।
সমাজ সভ্যতা যতো এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, ততোই যেন এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে। মানুষ যতোই সচেতন হচ্ছে, ততোই যেন নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে উদাসীনতা।
বড় আফসোস, পরিতাপের বিষয় কেন এমনটি হচ্ছে। কেন আজ এ জাতি এরকম অধঃপতনে। নির্যাতিত নারীর আর্তনাদে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছে। এটা এমন চিৎকার, যা সহ্য করা যায় না। কিছু কিছু আর্তনাদ মাঝে মাঝে অনলাইনে ভেসে আসে। সেগুলো আসলে সহ্য করার মত নয়। কোনো হৃদয়বান মানুষ স্থির থাকতে পারবেনা।
কিছুদিন আগে সিলেটের একটি ঘটনা সারাদেশ নাড়িয়ে দিয়েছে। সে ক্ষত শুকাতে না শুকাতে আবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ। এছাড়া কিছু খবর আমাদের কানে আসে, আর বাকি বহু ঘটনা হয়ত ধামাচাপা পড়ে যায়। কেউ মুখ খুলে আর কেউ খুলে না।
বড় চিন্তার বিষয়, এভাবে কি ঘটতেই থাকবে? একটা ঘটনা ঘটবে, আমরা অনলাইনে প্রতিবাদ করলাম, রাজপথে মিটিং ও মিছিল করলাম দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল?
ভাবার দরকার কেন হচ্ছে? এর সমস্যাটা কোথায়? একদম গোড়া থেকে বন্ধ করতে হবে। তাহলে হয়ত ধর্ষণের সংখ্যাটা কমে যাবে। তবে এই মূলে তো আমরা কেউ যাই না। যারা আজ রাজপথে মিটিং, মিছিল ও প্রতিবাদ করছেন, তারা কেউ এর মূলে যেতে চায় না।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নারী নির্যাতনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। অবশ্য তখন মানুষের মধ্যে এতো সচেতনতা ছিল না। তখন নারী নির্যাতন যে একটা অপরাধ সেটা হয়তো অনেকে জানত না।
এখন সময় পাল্টাচ্ছে। শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়েছে মানুষ। সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে সকল ক্ষেত্রেই। কিন্তু নারী নির্যাতনের মতো একটি মারাত্মক স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সনদ ও চুক্তি আছে, ইসলামের নানা বিধান আছে। কিন্তু এগুলোর কোন বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। সর্বোপরি আইন প্রয়োগকারী ও আইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী ও দরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে।
যারা ধর্ষক তারা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে শক্তিশালী৷ অন্যদিক বাদ দিলেও লৈঙ্গিকভাবে পুরুষ শক্তিশালী৷ তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী৷ নারীদের সামাজিকভাবে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা এবং সাক্ষ্য আইনে নানা সমস্যা রয়েছে৷ আছে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর চরিত্র হননের সুযোগ৷
আদালতে নারীকেই প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কি না? একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা না করলে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়৷ আদালতে তাকে অনেক বিব্রতকর প্রশ্ন করা হয়৷ ফলে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে৷
আজকাল ধর্ষণ কেন হচ্ছে? ইভটিজিং কেন হয়? এটা দেখার দরকার আগে। এটা যদি আবিষ্কার করা যায়, তাহলে দেখবেন, ধর্ষণ কমে গেছে।
দুর্গন্ধ যে জানালা দিয়ে আসে, সেটা বন্ধ করতে হবে।সাথে সাথে দুর্গন্ধের উৎপত্তিস্থল কোথায়? সে জায়গা পরিস্কার করে ময়লার গন্ধ দুর করা চাই। একদম আবর্জনার স্তুপ সরিয়ে ফেলতে হবে।
আপনি জানালা বন্ধ করবেন না, আবার ঘরের পাশের ময়লার স্তুপ সরাবেন না, তাহলে ঘরে তো দুর্গন্ধ আসবেই। যতই ঘর পরিস্কার করুন আসল জায়গা পরিস্কার না করলে কোন দুর্গন্ধ যাবে না।
এখানে যুব সমাজকে আমরা ঠিক হতে বলছি, ওদিকে আবার যুবতীদের উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে হলে, জানালা বন্ধ রাখা চাই, সেই সাথে দুর্গন্ধের উৎপত্তিস্থলে ঔষধ দিতে হবে, যাতে আর দুর্গন্ধ না ছড়ায়।
বেহায়াপনা বন্ধ করতে পারলে অনেকখানি নিরাপদে থাকবেন আমাদের মা-বোনেরা। জায়গায় জায়গায় যে সব অশ্লীল নৃত্য, অবৈধ ভাবে চলাফেরা। ছেলে-মেয়ে এক সাথে ঢলাঢলি। বিশেষ করে, নানান প্রোগ্রামের নামে নারীরা তাদের সংযত রাখতে ব্যর্থ, যার কারণে আরো সমস্যটা প্রকট হচ্ছে।
যে সব কারণে ধর্ষণ, ইভটিজিং ও নির্যাতন বাড়ছে:
১. ধর্ষণ বাড়ছে রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায়। কিছু লোক আছে অপরাধ করে যায়, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্র ছায়ায়। ওরা জানে, আমি যতবড় অপরাধ করিনা কেন নেতা আমাকে ছাড়িয়ে আনবে। এজন্য সে তখন আর কোন আইন-কানুনের ভয় করেনা। অপরাধ করে লাগামহীন ভাবে।
২. আপোসে জেনা বা অশ্লীলতা। আজকাল কিছু ছেলে-মেয়েরা অবাধে মেলামেশা করে যাচ্ছে, যেটাকে তারা কিছু মনে করছে না। বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফিজিক্যালী সম্পর্ক তাদের কাছে দোষনীয় নয়। এই অপরাধটা এক সময়ে ধর্ষণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
৩. সহ শিক্ষা। ছেলে মেয়ে এক সাথে ওঠা বসা করা। এক সাথে ঘুরে বেড়ানো। অবাধে নারীদের চলাফেরা এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪. টিভি, ইউটিউব, সিনেমাতে অশ্লীল নাচগান, বিজ্ঞাপন ও অভিনয় বন্ধ রাখা সময়ের দাবী। ঐ সকল অশ্লীল দৃশ্য দেখার পর যুব সমাজ অন্যায়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
৫. স্যাটেলাইট চ্যানেলে অশ্লীলভাবে প্রদর্শিত নাচগান, বিজ্ঞাপন ও অভিনয় এর ব্যাপারে যুবকদের ফিরিয়ে রাখা। তার পরিবর্তে চরিত্রগঠন হয়, আখলাক দুরুস্ত হয়, এমন প্রোগ্রাম চালু করা প্রয়োজন।
৬. বর্তমান অবস্থা হল। যখনই কোন অপরাধী ধরা পড়ে, সাথে সাথে নেতাদের ফোন চলে যায়। পুলিশ আর আসামিকে আটকিয়ে রাখতে পারেনা।
৭. ধর্মীয় কোন শিক্ষা না থাকা। নৈতিক চরিত্র গঠন হয়নি। যে শিক্ষায় মানুষের চরিত্র গঠন হয়, এমন শিক্ষার প্রয়োজন। বিশেষ করে, যুবক-যুবতীতের নৈতিক শিক্ষার বড্ড অভাব হয়ে দাড়িয়েছে।
৮. ইসলামী অনুশাসন মেনে না চলা। অধিকাংশ জায়গায় ধর্ষণ হচ্ছে, কিছু কিছু নারীর বেপরোয়া চলাফেরাতে যুবকদের লোভাতুর দৃষ্টি সেখানে পড়ছে, যার কারণে এধরণের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
৯. ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। ধর্ষককে যদি উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হতো, তাহলে এটা দেখে এই রকম জঘন্য কাজে আর কেউ এগোতো না। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় হলো, ধর্ষকগণ কোন কায়দায় আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখা যায়, এমন অঘটন ঘটিয়েছে সারাদেশ নড়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল, সে অপরাধী আগের অবস্থায় বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এরকম বহু সমস্যায় জর্জরিত আমাদের যুব সমাজ। যার কারণে ধর্ষণ, ইভটিজিং বেড়েই চলেছে। আমাদের এই জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। যার থেকে উঠে আসা দুস্কর।
এধরণের ঘটনা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের কি করনীয়?
১. ইসলামী আইন অনুযায়ী যদি ধর্ষকের সাজা হলে, পুরো দেশের জনগণের শিক্ষা হয়ে যেত। যেমন ইসলামে আছে, কোন বিবাহিত নারী ও পুরুষ যদি জেনা করে, তাহলে তাদের শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। রজম করা হবে। পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা হবে। হাজারো জনতার সম্মুখে। অবিবাহিত কেউ যদি জেনা করে, তাহলে তার শাস্তি হল, বেত্রাঘাত করা। একশত বেত্রাঘাত করা হবে। এমনি ভাবে ধর্ষণ করা, বলাৎকার করা, এটা তো আরো জঘন্যতম। কেননা, জেনা করার যে কঠিন শাস্তি, সেখানে যদি আবার জোরপুর্বক ধর্ষণ করে, তাদের শাস্তি আরো কঠিন। কোন ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে, বা জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করে, তার শাস্তি আরো কঠিন। ইসলামী কায়দায় ধর্ষকদের যদি এভাবে প্রকাশ্যে শাস্তির আওতায় আনা যায়, তাহলে দেখা যাবে সারা দেশের মানুষ সোজা হয়ে গেছে।
২. আমাদের নেতাগণ যদি শপথ করতেন, আমি কোন অপরাধীকে আশ্রয় দেব না। কেননা, অপরাধীর কোন দল নেই। এটা মনে করলে, কোন অপরাধীর নিস্তার থাকতনা।
ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হলে অবশ্যই ধর্ষণ কমে যাবে। যে দেশে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক ধর্ষণের বিচার হয়, সেখানে ধর্ষণের মাত্রা অনেক কম। সারাদেশে ধর্ষণের কোন ঘটনা হয় না। কেননা, ইসলামী আইনে ধর্ষকদের বিচার এত কঠোর, সে বিচার দেখলে আর কেউ ধর্ষনের মত জঘন্যতম কাজ করতে পারবেনা।
সবচেয়ে বড় দুঃখের কথা হল, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না থাকার কারণে ওরা আশকারা পাচ্ছে। বারবার অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এজন্য কঠিন শাস্তি হলে ওরা দমে যাবে ইনশাআল্লাহ।
তাই নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য কঠিন আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধ করতে পারবে যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার, গড়ে উঠবে নারী সহিংসতা মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ।
আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক: সাংবাদিক।