সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ইসলাম ধর্ম ও সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ
এম. হাছিবুল ইসলাম
ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শিক চিন্তামূলক রাষ্ট্র।
ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে নিয়ে ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা।
তবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্য রক্ষা করা হয়েছে ইসলামে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাসহ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া সকল দেশের সকল সমাজের মানুষের জন্য পালনীয় প্রশস্ততা ইসলামে রয়েছে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মুমিনের ধর্ম পালনের জন্য শর্ত বা মূল বিষয় বলে গণ্য করা হয়নি। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামের একটি অংশ। ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান আছে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম:
রাষ্ট্র হলো এমন একটি জনসমষ্টি আধ্যুষিত ভূ-খন্ড যার একটি সরকার এ একটি সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে।
আর ইসলামী রাষ্টে হচ্ছে, যে রাষ্ট্র কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামী শরিয়তের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ইসলামী রাষ্ট্রকে “দারুল ইসলাম” বলা হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকরাও পুর্ণ মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বসবাস করে।
ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন তথা পবিত্র কুরআনের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা অন্যতম বিধান। তা প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী আকীদা ও বিশ্বাসের উপর, ইসলামী আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের ওপর। এজন্যে ইসলামী রাষ্ট্র কোনো ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সীমিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়।
ইসলামি রাষ্ট্র হল একপ্রকার রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে সরকারের কার্যের প্রথম ভিত্তি হল শরিয়াহ।
বস্তুত ইসলামী শরীয়তের বিধান আল্লাহর এ দাবীর সত্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে। শরীয়তের বিধানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়েই আইন-বিধান দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি, তার পরামর্শভিত্তিক তথা গণতান্ত্রিক হওয়া, শাসন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা, ন্যায়সঙ্গত কাজে তাদের আনুগত্য, যুদ্ধ, সন্ধি, চুক্তি প্রভৃতি সর্ববিষয়ে অকাট্য বিধান রয়েছে ইসলামী শরীয়তে।
কুরআন-হাদীসে আমীর, ইমাম ও সুলতান প্রভৃতি পারিভাষিক শব্দগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে।
এ শব্দগুলো বুঝায় সেই ব্যক্তিকে যার হাতে রয়েছে সার্বভৌমত্ব, শাসন ও আইন রচনার ক্ষমতা।
আধুনিক পরিভাষায় তাই হলো সরকার বা গভর্নমেন্ট।
সরকার বা গভর্নমেন্ট হলো রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাজেই যেসব আয়াত এবং হাদীসের যেসব উক্তিতে এ পরিভাষাগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করা একান্তই জরুরী।
কেননা, এগুলো শুধু পড়া বা মুখে উচ্চারণের জন্যেই বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে এজন্যে যে, তা যেমন পড়া হবে তেমনি তাকে কার্যকরী করাও হবে।
আর এগুলো কার্যকরী করতে হলে ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান অনুযায়ী পূর্নাঙ্গ রাষ্ট্র কায়েম করা অপরিহার্য।
শরীয়তের নির্দেশ পালন ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাছাড়া শরীয়তের এমন অনেকগুলো আইন-বিধান রয়েছে যা কার্যকরী করতে হলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করে সেগুলোর বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভবপর নয়। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মানুষের পরস্পরের বিচার-ফায়সালা করার এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে কুরআন-হাদীসে।
কিন্তু রাষ্ট্র যতক্ষণ পর্যন্ত এ কাজ না করবে ততক্ষণ কোনো ব্যক্তি বা সমাজের সাধারণ মানুষের পক্ষে তা করা কিছুতেই সম্ভবপর হতে পারে না। এজন্যেই জনগণের উপর কোনো কিছু কার্যকরী করার ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা একান্তই জরুরী।
জনগণের যাবতীয় ব্যাপার সুসম্পন্ন করা- রাষ্ট্র কায়েম করা দীনের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। বরং রাষ্ট্র ছাড়া দীন প্রতিষ্ঠা হতেই পারে না। আরো কথা এই যে, আল্লাহ তায়ালা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং নিপীড়িতদের সাহায্য করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
এভাবে তিনি জিহাদ, ইনসাফ ও আইন-শাসন প্রভৃতি যেসব কাজ ওয়াজিব করে দিয়েছেন তা রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র কর্তৃত্ব ছাড়া কিছুতেই সম্পন্ন হতে পারে না।
ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি?
ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তাই, যা প্রমাণিত ও স্বতপ্রকাশিত হয় তার প্রকৃতি থেকে। তা যতদিন একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন তা থাকবে ইসলামী আদর্শ ও বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
কাজেই অতি স্বাভাবিকভাবেই সে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে তাই যা ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ কারণে নাগরিকদের জন্যে শুধু শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের জীবন সংরক্ষণ ও বহিরাক্রমণ প্রতিরোধ পর্যন্তই তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও দায়িত্ব সীমিত হয়ে যেতে পারে না।
বরং রাষ্ট্রের সর্বদিকে সর্ব ব্যাপারে ও সর্ব ক্ষেত্রেই ইসলামী আইন বিধান পূর্ণ মাত্রায় কার্যকরী করা, জারি করা এবং মানব সমাজের সর্বস্তরে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছে দেয়াও তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
সেই সাথে ইসলামী আকীদা মোতাবেক ব্যক্তিগণকে আল্লাহর বন্দেগী করা, বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ এবং ইসলামী বিধান মোতাবেক বাস্তব পূর্নাঙ্গ জীবন যাপনের অবাধ সুযোগ সুবিধে করে দেয়াও তার কাজ।
ইসলামের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা, শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকদের মন-মগজ ও মানসিকতা এবং স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণকে ইসলাম অনুরূপ বানিয়ে দেয়াও তার বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
এখানেই শেষ নয়, ইসলামী আদর্শের বিকাশদান ও তা অনুসরণ করে চলার পথে যত প্রকারেরই প্রতিবন্ধকতা হতে পারে তার সব দূর করা, ইসলাম বিরোধী চিন্তা, সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কীয় মতের প্রতিরোধ করাও তার কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
মারূফ কাজের আদেশ ও শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে বিরত রাখার কথা বলে ইংগিত করা হয়েছে জনগণের জন্য ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জীবন যাপনের সুযোগ-সুবিধে করে দেয়া ও সর্ব ব্যাপারে ইসলামী আইন-কানুন জারি করার দিকে।
এসবই হলো ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এসব কিছুরই লক্ষ্য রাষ্ট্রের জনগণের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে শরীয়ত ভিত্তিক কল্যাণ সাধন।
এ কারণেরই ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে অন্যান্য সর্বপ্রকার রাষ্ট্রের তুলনায় অধিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।
একথাই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, তারা সেইসব লোক, যাদের আমি যদি দুনিয়ার কোনো অংশে ক্ষমতাসীন করে দেই, তাহলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রচলন করবে, লোকদেরকে যাবতীয় মারূফ কাজে বাধ্য করবে ও শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত সব ব্যাপারে চূড়ান্ত ক্ষমতা আল্লাহরই জন্যে। (সূরা আল হাজ্জ, ৪১)
হযরত মুহম্মদ (সা:) ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যেভাবে ভুমিকা পালন করেছিলেন-
শিক্ষা ব্যবস্থায় আদর্শ :
তিনি সার্বক্ষণিক শিক্ষক ছিলেন। রাসূল (সা:) তাঁর জনগণকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সর্বদা তৎপর ছিলেন।
যেহেতু পবিত্র কুরআনের প্রথম বাণী “ইকরা” অর্থাৎ “পড়ো”।
মসজিদে নববীকে তিনি একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। বদরের যুদ্ধে শিক্ষিত মুশরিকদের অশিক্ষিত মুসলিমকে শিক্ষা দিয়ে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন।
মুসলমানদের নৈতিক শক্তি বলে বলীয়ান বা নৈতিকতা সম্পন্ন লোক তৈরি :
মুসলমানদের নৈতিক শক্তিই যেকোন আন্দোলনকে প্রভাবশালী ও কার্যকরী করতে এবং বিজয়ী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই রাসূল (সা:) নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরীর উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
সাংবিধানিক চুক্তি :
রাসূল (সা:) নিজের রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলো ও আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর পক্ষে সকল শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের লোকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে “সাংবিধানিক চুক্তি ” লিপিবদ্ধ করেন। সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো- শুরু করা হয়েছিলো- “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” দিয়ে। শিরোনাম ছিলো-
“এ দলীল রাসূল (সা:) কর্তৃক জারীকৃত”।
সাংবিধানিক চুক্তি ছিলো ৫৩ টি ধারা সম্বলিত। সূচনাতেই ইসলামের মৌলিক মতাদর্শের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই সংবিধানে।
ভিক্ষুকদের এবং বেকারকে উদ্বুদ্ধকরণ :
রাসূল (সা:) হীন ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করেছেন। একদা এক ব্যক্তিকে তার শেষ সম্বল দিয়ে কুঠার কিনে দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করান এবং কর্মসংস্থানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে অনুসরণীয় আদর্শ সৃষ্টি করেন।।
দার্শনিক মাইকেল হার্ট বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি অশান্তির বিশ্বে শান্তি আনতে হলে সমগ্র বিশ্বের একক ক্ষমতা আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক রাসূল (সা:) এর হাতে অর্পণ করলেই তা শুধু সম্ভব”।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি :
রাসূল (সা:) যে আন্দোলন করেছিলেন তা একদিকে মানুষের হৃদয়কে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত ও আত্মাকে নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ করত এবং অপর দিকে পেটের খাদ্য সরবরাহের সর্বোত্তম ব্যবস্থাও ছিলেন। যদি অস্ত্রের বলে ক্ষমতা দখল করে, কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার ঘটাতে না পারে, তাহলে নিছক সংশোধন এবং পুনর্গঠনের উপদেশ গ্রহণে মানুষ তৈরি হতে পারে না।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট।